সম্পাদকীয়|Editorial
DOI:
https://doi.org/10.58666/h0kbt925Abstract
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। দারিদ্র্য এখনও আমাদের প্রধানতম সমস্যা। সীমিত সম্পদ দিয়ে পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণের এক কঠিন যুদ্ধ করে যাচ্ছে এ দেশ। দেশের সুবিধাবঞ্চিত, অতিদরিদ্র ও পিছিয়ে-পড়া জনগোষ্ঠীর কল্যাণে সরকারের একটি মানবিক প্রকল্প ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি’। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে চলমান এ কর্মসূচির আওতায় লক্ষ লক্ষ সহায়হীন ও দরিদ্র মানুষের দোরগোড়ায় নিয়মিত পৌঁছে যাচ্ছে সরকারের মানবিক সহায়তা। এ কর্মসূচির আওতাধীন প্রতিটি বিষয়ে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন সময়ে গবেষণা পরিচালিত হলেও ইসলামী নির্দেশনার আলোকে এগুলোর সামগ্রিক ও বিষয়ভিত্তিক পর্যালোচনার প্রয়োজন পূরণ করা হয়েছে “বাংলাদেশ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি : কুরআন ও হাদীসের আলোকে একটি পর্যালোচনা” শীর্ষক প্রবন্ধে। প্রবন্ধটিতে কুরআন ও হাদীসের আলোকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পর্যালোচনার পাশাপাশি ইসলামে সমাজসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তার ধারণা, ইসলামে রাষ্ট্রীয় ভাতার সূচনা সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাত করা হয়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তার অন্যতম শর্ত সমাজ থেকে সব ধরনের সামাজিক ব্যাধি দূর করা। এসব ব্যাধির মধ্যে পরকীয়া একটি ভয়াবহ ব্যাধি। বাংলাদেশ আজ এই ব্যাধির সংক্রমণে জর্জরিত। পরকীয়ার অভিশাপ নারী-পুরুষের হত্যা, আত্মহত্যা বা বলিদানেই শেষ হয় না; বরং তার বিষক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমাজ। পরকীয়া প্রেমের নামে অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক আজ আমাদের সমাজকে কলুষিত করছে, ভেঙ্গে দিচ্ছে সমাজ ও পারিবারিক শৃঙ্খলা। আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামের সামাজিক বিধানের যথাযথ বাস্তবায়ন এই ব্যাধি থেকে সমাজকে মুক্ত করতে পারে। “ইসলামে পরকীয়ার বিধান ও বাংলাদেশে প্রচলিত আইন : একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ” শীর্ষক প্রবন্ধে তাই পরকীয়ার কালো থাবা থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য কুরআন-সুন্নাহ্র নির্দেশনা তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি পরকীয়ার শাস্তি সম্পর্কে বাংলাদেশে প্রচলিত দ-বিধির সঙ্গে ইসলামী আইনের তুলনা করে প্রচলিত আইনের দুর্বল দিকগুলো পর্যালোচনাপূর্বক তা পরিমার্জনের সুপারিশ করা হয়েছ।
ইসলামের সামাজিক বিধান অশান্ত, বিশৃঙ্খল ও শতধা-বিভক্ত সমাজে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে নির্দেশনা প্রদান করে। ইসলাম বিশ্বমানবতাকে এমন এক সভ্যতা উপহার দেয়, যা মানুষকে মানবতা, পরমতসহিষ্ণুতা এবং ঔদার্যের দৃষ্টিকোণ থেকে উপলব্ধি ও হৃদয়ঙ্গম করতে শেখায়। ফলে আলোকিত হয় সমাজ; তিরোহিত হয় নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা ও ধর্মীয় কলহ-বিবাদ। ইসলামের নিরন্তর প্রয়াসে মানুষ সম্প্রদায়গত ভিন্নতা ও ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ হয়। এ ভ্রাতৃত্ব, প্রীতি, বিশ্বস্ততা ও আমানতদারিতার বিধান প্রতিফলিত হয় সমাজের সর্বক্ষেত্রে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থায়নেও এর প্রভাব পড়ে। কেননা ইসলামী অর্থায়নপদ্ধতির মৌলিক রূপ হচ্ছে লাভ-লোকসানে অংশীদারত্বভিত্তিক অর্থায়ন এবং সকল অর্থায়নের বিপরীতে সম্পদের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকা। এই অর্থায়ন ব্যবস্থার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো ব্যবসায়ীদের বিশ্বস্ততার সঙ্গে ব্যবসায়িক কার্যাবলি পরিচালিত করতে উদ্বুদ্ধ করা। এতে একজন ব্যবসায়ী তার প্রতি অবিচার ও জুলুমের ভয়মুক্ত হয়ে নিজের মেধা ও যোগ্যতার সবটুকু নিয়োজিত করতে পারেন এবং প্রকৃত কোনো ক্ষতির সম্মুুখীন হলে তার উপর ঋণের ভয়াবহ বোঝা বহনের অমানবিক ও অযৌক্তিক মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। ইসলামী অর্থায়নের এই পদ্ধতি ব্যবসায়ী বা ঋণগ্রহীতাকে একজন উন্নত চরিত্রের বিশ্বস্ত মানুষে পরিণত হতে সাহায্য করে, এতে তার দুনিয়ার কল্যাণ যেমন সাধিত হয় তেমনি মুসলিম হলে তার পরকালীন জীবনকেও সফল করে তোলে। পক্ষান্তরে তিনি অমুসলিম হলে দুনিয়াতে ভাল ও উত্তম মানুষ হিসেবে পরিচিত হন, যার দ্বারা সমাজ উপকৃত হয়। সর্বোপরি ইক্যুইটিভিত্তিক অর্থায়ন ব্যবস্থাতেই বিনিয়োগকারীর সম্পদ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও মূলধন ঝুঁকি থেকে অনেকাংশেই মুক্ত থাকে। “ইক্যুইটিভিত্তিক অর্থায়নের গুরুত্ব : সমকালীন প্রেক্ষাপটে একটি বিশ্লেষণ” শীর্ষক প্রবন্ধে এ বিষয়ক পর্যালোচনা স্থান পেয়েছে।
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেসব সামাজিক সমস্যা ক্রমশ ভয়াবহরূপ ধারণ করেছে তন্মধ্যে কিশোর অপরাধ অন্যতম। বর্তমান সময়ে কিশোরদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ, হত্যা, মাদকসেবন, ইভটিজিংসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। কিশোরদের এহেন অনৈতিক ও চরিত্র-বিধ্বংসী কাজ সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, আইনবিদ, রাজনীতিবিদ ও সুশীলসমাজকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছে এবং তারা একে জাতির জন্য অশনিসংকেত মনে করছেন। এ সর্বনাশা ছোবল থেকে কিশোর সমাজকে বাঁচানোর লক্ষে করণীয় নির্ধারণের জন্য প্রণীত হয়েছে, “কিশোর অপরাধের কারণ ও প্রতিকার : ইসলামী দৃষ্টিকোণ” শীর্ষক প্রবন্ধটি। যা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, বর্তমান বিশ্বে অপরাধের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত কিশোর সমাজকে ইসলামী আদর্শ সত্যিকারভাবে অনুসরণ করার মধ্য দিয়ে অপরাধমুক্ত করা সম্ভব হবে।
ইসলামের সামাজিক বিধানের অন্যতম অংশ হলো আর্থ-সামাজিক বিধান। আদর্শ ও মূলনীতির দিক দিয়ে যা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। কেননা ইসলাম মানবজাতির জন্য প্রদত্ত চিরন্তন কল্যাণকর পরিপূর্ণ জীবন-ব্যবস্থা। মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, নৈতিকতা, চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস, কর্ম, আচরণ, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, মূল্যবোধ তথা সমগ্র জীবনধারার সঙ্গে সমন্বিত ও সম্পৃক্ত রেখে আর্থ-সামাজিক জীবন পরিচালনার জন্য ভারসাম্যপূর্ণ অর্থব্যবস্থা ইসলামী জীবনধারার বৈশিষ্ট্য। ইসলাম মানবজীবনে অর্থের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে ঠিকই, কিন্তু অর্থ উপার্জনের অবাধ সুযোগ দেয় না। বরং সম্পদ উপার্জনের পন্থা ও উপায়ের ক্ষেত্রে সামাজিক স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে বৈধতা-অবৈধতার বিধান দিয়ে সমাজ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর প্রবণতা ও কর্মকা- নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর মধ্যে সুদ সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা সবচেয়ে বেশি কঠোর। করাণ সুদ একমুখী অর্থপ্রবাহের এক ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া। আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদদের দৃঢ় বিশ্বাস যে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির স্বার্থে সুদ অপরিহার্য। কিন্তু মুসলিম অর্থনীতিবিদদের গবেষণায় প্রমাণিত যে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সুদ মোটেও অপরিহার্য নয়। এর মাধ্যমে অর্থব্যবস্থায় সম্পদের যতই প্রবৃদ্ধি ঘটুক, সার্বিকভাবে তা মানব সমাজের জন্য মোটেই কল্যাণকর হতে পারে না। সুদ কিভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়, কিভাবে গ্রামীণ উন্নয়নকে ব্যাহত করে, কিভাবে দরিদ্র শ্রেণী আরো দারিদ্র্যের কবলে পতিত হয়, কিভাবে সুদের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থব্যবস্থার মেরুদ- ভেঙ্গে যায় ইত্যাদি দিক বিশ্লেষণ করে “গ্রামীণ উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে সুদ : ইসলামের আলোকে একটি সমীক্ষা” শীর্ষক প্রবন্ধটি রচিত হয়েছে।
আশা করি ইসলামী আইন ও বিচার জার্নালের ৬৪ তম সংখ্যায় প্রকাশিত সমসাময়িক ও আলোচিত বিষয়ে রচিত প্রবন্ধগুলো থেকে সংশ্লিষ্ট সকলে উপকৃত হবেন। মহান আল্লাহ আমাদের এ প্রচেষ্টাকে কবুল করুন।
- প্রধান সম্পাদক
Downloads
Published
Issue
Section
License
Copyright (c) 2021 ইসলামী আইন ও বিচার | Islami Ain O Bichar
This work is licensed under a Creative Commons Attribution 4.0 International License.